পরীক্ষা শুরুর আগেই এইচএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস!

পরীক্ষা শুরুর আগেই এইচএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস!
২৪/০৪/২০১৬ ১২:০৪ এ. এম.
বেলাশেষে ॥ ‘প্রতিদিনের মতো আজকের সকাল বেলা প্রশ্ন সবাইকে ফ্রি দিলাম, শুধু প্রমাণ দেয়ার জন্য। পরীক্ষা হল থেকে এসে মিলিয়ে নিও। আর যারা আগের দিন ১০,০০০ টাকা দিতে পেরেছো তাদের একদিন আগে এই প্রশ্নটা দিয়েছিলাম। অনেকেই বিশ্বাস করতে পারো নাই তাদের কাছে প্রমাণ দেয়ার জন্য দিলাম।’
রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে এভাবেই চলমান এইচএসসি পরীক্ষার একের পর এক প্রশ্ন ফাঁস করছে একটি বিশেষ গোষ্ঠী। সরকারের সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষা কর্মকর্তা এমনকি বিটিআরসি কেউই অপরাধীর নাগাল পাচ্ছে না। পর পর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কয়েকটি পরীক্ষা শুরুর আগে সকাল নয়টা থেকে নয়টা ৫ মিনিটের মধ্যে ফেসবুকে মূল প্রশ্নের ছবি তুলে হুবহু প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হচ্ছে, যেখানে ঘোষণা দিয়েই পরপর একই কাজ নির্বিঘেœ করে যাচ্ছে আহমেদ নিলয় নামে একজন। পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই ফেসবুকে তার টাইমলাইনে সর্বশেষ জীববিজ্ঞান প্রশ্নপত্রটি পাওয়া যাচ্ছিল। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে ফেসবুকে প্রকাশ করা প্রশ্নের হুবহু মিলও পাওয়া গেছে। এদিকে ঘোষণা দিয়ে এভাবে একের পর এক প্রশ্ন হুবহু ফাঁস করার ঘটনা নজরে এসেছে শিক্ষা বোর্ডের। ইতোমধ্যেই পরীক্ষা শুরুর আগে ঢাকার কয়েকটি কলেজে অভিযান চালিয়েছেন কর্মকর্তারা। কিন্তু এখনও অপরাধীরা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বোর্ডের পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে দ্রুত বিষয়টি পরীক্ষা সংক্রান্ত আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাধ্যমে বিটিআরসিকে অবহিত কয়ে এ্যাকশন নিতে। তবে বোর্ড কর্মকর্তারা সন্দেহ করছেন, পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্নে বান্ডিল খোলার পরই একটি চক্র মোবাইলে সেই প্রশ্নের ছবি করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকার লেনদেনেরও প্রমাণ মিলছে না। বরং ফেসবুকে ছেড়ে দিয়ে একটি চক্র সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চায় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই ফেসবুকে এইচএসসি’র প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন আহমেদ নিলয় নামে এক ব্যক্তি। জীববিজ্ঞান দ্বিতীয়পত্রের বহু নির্বাচনী (এমসিকিউ) ও তত্ত্বীয় অংশের প্রশ্নপত্রটি ইমেজ (ছবি) আকারে আপলোড করেছেন। অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পান বোর্ড কর্মকর্তারাও। এর আগে গত মঙ্গলবার জীববিজ্ঞান প্রথমপত্র পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই প্রশ্ন ফাঁস করেন একই ব্যক্তি। আহমেদ নিলয় নামের ওই ব্যক্তি তার ফেসবুক পেজে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের জীববিজ্ঞান দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষার প্রশ্ন ঠিক সকাল আটটা ৫০ মিনিটে আপলোড করেন। তিনি তার ফেসবুকে বুয়েট ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। তবে বুয়েট ছাত্রলীগ সভাপতি শুভ্র জ্যোতি টিকাদার তাদের সংগঠনে এই নামের কেউ নেই বলে জানান। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই ব্যক্তি কেবল নিজের পরিচল বলাতেই মিথ্যার আশ্রয় নেননি, একই সঙ্গে ফেসবুকে যে ছবি ব্যবহার করেছেন তাও অন্যের। ছাত্রলীগ পরিচয় দিয়ে অপরাধীরা মূলত সরকারকে বিব্রত করতে চায় বলেই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
আহমেদ নিলয় নামে বুয়েট ছাত্রলীগে কোন দফতর সম্পাদক, সাধারণ কোন কর্মী বা এমনটি শিক্ষার্থী নেই জানিয়ে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি শুভ্র জ্যতি টিকাদার বলেন, আহমেদ নিলয় নামের এই ছেলেটার ফেসবুক আমিও দেখেছি। সে বুয়েট ছাত্রলীগ দফতর সম্পাদক পরিচয় দিয়ে ফেসবুক আইডি খুলেছে। এটা একটি ফেক আইডি। আমি সরকারের অনেকেরই নজরে এনেছি বিষয়টি। এ নিয়ে আমি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসও দিয়েছি। আমি মনে করি একটু চেষ্টা করলেই এই অপরাধীকে ধরা সম্ভব।
এদিকে অপরাধী ছবি ব্যবহারেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। মেজবাউল করিম অপু নামের এক যুবকের ছবি ব্যবহার করে চলমান এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করছে ‘আহমেদ নিলয়’ নামের একটি ফেসবুক এ্যাকাউন্ট। বিষয়টি জেনে এরই মধ্যে ওই যুবক এ বিষয়ে পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (নম্বর ১৪৬৫) করেছেন। ডায়েরিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, কোন এক ব্যক্তি আমার ছবি ব্যবহার করে অপকর্ম করছে। অনলাইন নিউজ পেপারের মাধ্যমে তা জানতে পেরেছি।
মেজবাউল করিম তার সাধারণ ডায়েরিতে আরও উল্লেখ করেছেন, আহমেদ নিলয় নামে একটি ফেসবুক আইডিতে আমার নিজের ফেসবুক পেজ (মেজবাউল করিম অপু) থেকে ছবি সংগ্রহ করে ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই এ্যাকাউন্ট থেকে কিছু অপ্রীতিকর কর্মকা- করা হচ্ছে। জীবনের ওপর বড় ধরনের কোন হুমকি আসতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি ওই সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
তবে বসে নেই অপরাধী। গত বৃহস্পতিবার পরীক্ষার শুরুর আগেই প্রশ্নপত্র আপলোড করে অপরাধী আহমেদ নিলয় তার ফেসবুক টাইমলাইনে লিখেছেন, ‘সালা সাংবাদিকদের জন্য কিচ্ছু দিতে মন চায় না। অনেক বড় বিপদে আছি, তারপরও সাহায্য না করে পারলাম না। সবাই দোয়া করো। ইনশাল্লাহ যাতে তোমাদের পাশে থাকতে পারি। সকাল বেলা সবাইকে আগে প্রশ্ন টা ফ্রি দিলাম’। এর আগে গত মঙ্গলবার তিনি তার টাইমলাইনে লিখেছিলেন, প্রতিদিনের মতো আজকের সকাল বেলা প্রশ্ন সবাইকে ফ্রি দিলাম, শুধু প্রমাণ দেয়ার জন্য। পরীক্ষার হল থেকে এসে মিলিয়ে নিও।’ বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে আরও লেখা হয়েছে, ‘এখন কিছু চিটার বাটপাড় আছে, যারা আমার ফ্রি দেয়া প্রশ্নের কপি মেরে, ৫০০/১০০০ টাকা বিক্রি করছে। এদের থেকে সাবধান হন, এবং চিটার বাটপাড়গুলোকে ধরতে সাহায্য করেন।’
ঘোষণা দিয়ে এভাবে একের পর এক প্রশ্ন হুবহু ফাঁস করার ঘটনা নজরে এসেছে শিক্ষা বোর্ডের। ইতোমধ্যেই পরীক্ষা শুরু আগে ঢাকার কয়েকটি কলেজে অভিযান চালিয়েছেন কর্মকর্তারা। ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ বলছিলেন, বিষয়টি আমাদেরও নজরে এসেছে। ইতোমধ্যেই আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। তারা বিটিআরসিকে জানিয়ে তদন্ত করছে। আমি নিজে কথা বলেছি মন্ত্রণালয়ে। আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাধ্যমে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
এ কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্ন সকাল নয়টার মধ্যেই পৌঁছে যায়। সেখান থেকেই বান্ডিল খোলার পর এটি কোন কেন্দ্র থেকে ফাঁস করা হয়েছে বলে বোঝা যাচ্ছে। কারণ মোবাইলে ছবি করে হুবহু প্রশ্ন দেয়া হচ্ছে বলেই প্রমাণ মিলেছে। সর্বশেষ একটি পরীক্ষায় যদিও প্রশ্ন দিতে পারেনি অপরাধীরা। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জানান, আমরা ইতোমধ্যেই রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণখানে কয়েকটি কেন্দ্রে পরীক্ষার দিন সকাল ৯টার আগে অভিযান চালিয়েছি। তবে সেসব কেন্দ্রে বান্ডিল বন্ধই পেয়েছি।
এদিকে প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। তবে শিক্ষাবিদরা ফেসবুকে প্রশ্ন ছেড়ে দেয়ার ঘটনাকে কোন কেন্দ্রের ইচ্ছাকৃত অপকর্ম হিসেবে অভিহিত করেছেন। জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবীর বলছিলেন, দুটি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হলো? বিষয়টা আসলেই উদ্বেগজনক। তবে যেহেতু আগের দিন ফাঁস হচ্ছে না, হচ্ছে পরীক্ষার দিন সকালে। এটা পরিষ্কার যে কেন্দ্রে প্রশ্ন গেলে এরপর তা ফাঁস করা হচ্ছে। এ শিক্ষাবিদ বলেন, ফেসকুকে দিয়ে দিলে টাকা পাওয়া যাবে না। তারপরও সেখানে দেয়া হচ্ছে। এর কারণ হলো, সরকারকে হেয় করা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে হেয় করা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিব্রত করা। না হয় প্রশ্ন বিক্রি করে টাকা আদায় করা হতো, প্রশ্ন এভাবে ফেসবুকে দেয়া হতো না। কেন্দ্র এ অফকর্মে আছে।
উত্তরার একটি নামি কলেজের অধ্যক্ষ বলছিলেন, আমার নজরেও এসেছে বিষয়টি। ছেলেমেয়েরা প্রশ্ন পাচ্ছে ফেকবুকে। আগের দিন কেউ পাচ্ছে না। পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগে পাচ্ছে। আমি বের করার চেষ্টা করছি কোথা থেতে তারা পাচ্ছে। এ অধ্যক্ষও বলছেন, কোন না কোন কেন্দ্র সকালে প্রশ্ন হাতে পাওয়ার পর কেবল সরকারকে বিব্রত করতেই এ কাজ করছে। প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। দ্রুত তদন্তের ব্যবস্থা করছি। তিনি আরও বলেন, আমরা বর্তমানে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে যে ধরনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি, তাতে তো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে মানতেও কষ্ট হয়। তবুও আমি অস্বীকার করছি না যে, সেটা একদমই অসম্ভব। তবে যদি প্রমাণিত হয় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে তবে ফাঁসকারী চক্রকে দ্রুত ধরার ব্যবস্থা করব এবং আইন অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
তবে ফেসবুকে প্রশ্ন ফাঁস হওয়া বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁস কিভাবে সামলাব? পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগে প্রশ্ন কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে হয়।
মোড়ল মোঃ ইলিয়াস হুসাইন,সম্পাদক ও প্রকাশক “বেলাশেষে” দিঘলিয়া খুলনা।

image

image

image

image

আপনি ও লিখুন।

Leave a comment